হুমায়ুন আজাদের কিছু বই, আপনাকে হয়ত তার প্রতি ঘৃনা, বিরক্তি জাগাতে বাধ্য করতে পারে কিন্তু হুমায়ুন আজাদকে যদি বাস্তবেই চিনতে চান, তাকে কেন্দ্র করে আপনার ধ্যান-ধারণার যদি পরিবর্তন ঘটাতেই চান, তবে 'নারী' গ্রন্থটি এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে৷ হ্যা ধর্মকে কেন্দ্র করে তার কিছু কথাবার্তা
আপনার ধার্মিক মস্তিষ্কে আঘাত হানতে পারে, আপনার 'ধর্মানুভূতি' ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠতে পারে কিন্তু কোথাও আপনি অক্ষমতা অনুভব করবেন, আপনার মস্তিষ্কের কোনো এক অংশ আপনাকে জানাবে, আপনি অসহায়, ক্ষোভ ব্যতীত কোনো যৌক্তিক অস্ত্র আপনার কাছে নেই। জানতে পারবেন, এই ক্ষোভের উৎস, বুঝতে পারবেন যে, আপনি একজন পুরুষতান্ত্রিক! আপনার 'ধর্ম' সেই মধ্যযুগের কট্টর পুরুষতান্ত্রিক আমলে জন্ম নিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবে তার কিছু আচার-আচরণ পুরুষতন্ত্রের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
মূল
বিষয়
তো আগেই বলে রাখি
বইটি বাংলাদেশি লেখক
হুমায়ুন আজাদের একটি নারীবাদী রচনা। ।অর্থাৎ হুমায়ূন আজাদ যে নারীবাদকে সমর্থন করেন তা বিভিন্নভাবে এখানে তিনি
ফুটিয়ে তুলেছেন।
নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট তো নিশ্চয়ই আপনারা বুঝেন যেটা হলো নারীর সমঅধিকার অর্থাৎ পুরুষ-নারীর সমঅধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে যারা কথা বলেন তারাই নারীবাদী।
সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে নন্দিত ও নিন্দিত গ্রন্থ এই
"নারী"। উগ্র মৌলবাদ ও আমূল পুরুষতন্ত্রের রোষানলে পড়ে এই গ্রন্থ ১৯৯৫
সালে নিষিদ্ধ হয়, পরবর্তীতে ২০০০ সালে হাইকোর্টের আদেশে এটি পুনরায় মুদ্রিত হয়ে
পাঠক জগতে ঠাঁই নেয়। সমালোচকদের মতে নারীবাদ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ গবেষণা গ্রন্থ
এটি৷ বাংলা ভাষায়
নারীবাদের সূচনা হয় বেগম রোকেয়ার হাতে যদিও সেটি ছিলো অবিভক্ত ভারতীয় বঙ্গে, আর হুমায়ুন আজাদের লেখা
এই বইটিই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে নারীবাদ বিষয়ক প্রথম বই।বইটি লেখার জন্য প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ ৮১টি বিদেশী
ও ৮০টি বাংলা পুস্তক, জার্নাল, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের আশ্রয় নিয়েছেন। স্বাধীন
বাংলাদেশে নারীবাদ সংক্রান্ত এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ।
বইটিতে
ফুটে উঠেছে পুরুষতন্ত্র কর্তৃক নারী নির্যাতনের সুদীর্ঘ ইতিহাস, লৈঙ্গিক রাজনীতি ও
নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। পাশাপাশি পশ্চিমা ও পূবদেশীয় সাহিত্যজগত খুঁড়ে লেখক
বের করে এনেছেন নারীর চারদেয়াল-আবদ্ধকরণের চতুর ঐন্দ্রজালিক মহাকাব্য। সমালোচনা
করেছেন রাসকিন-রুশো-রবীন্দ্রনাথের নারীসংক্রান্ত ভিক্টোরীয় যুগের মানসিকতা।
এছাড়াও 'প্রেম ও কাম' অধ্যায়ে প্রেমের বিরোধিতা করে 'কাম' বা 'যৌনতা'র পক্ষে কথা
বলা হয়েছে এবং 'বিয়ে ও সংসার' অধ্যায়ে বিয়ের বিরোধিতা করা হয়েছে।
আসল রিভিউতে আসা যাক,
নারী
বইটিতে সর্বমোট ৪০৮ টি পৃষ্ঠা রয়েছে এবং অধ্যায় আছে ২১ টি (নারীবাদ ও নারীবাদের
কালপঞ্জি, রচনাপঞ্জি এবং নির্ঘন্ট সহ ২৪টি)।
অধ্যায়সমূহ
এই বইয়ের
অধ্যায়গুলো হলোঃ
1.
নারী ও তার বিধাতাঃ পুরুষ - এ
অধ্যায়তে বোঝানো হয়েছে যে, পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় এবং সমাজে পুরুষেরা বিধাতার
সমান (রূপকার্থে)।
2.
লৈঙ্গিক রাজনীতি - এই অধ্যায়তে বলা
হয়েছে যে, পুরুষেরা যৌনতার ক্ষেত্রেও এক ধরনের রূপক রাজনীতি করে, এছাড়া সমাজে
চলা লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা রয়েছে।
3.
দেবী ও দানবী - পুরুষতন্ত্র নারীদেরকে
একভাবে দেবী'র স্থান দেয় আবার দানবীও করে তোলে, এটা রূপকার্থে বোঝানো হয়েছে।
4.
নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয় -
প্রাচীন সভ্যতায় নারীদের অবস্থানের বিষয় এখানে বর্ণিত হয়েছে।
5.
পিতৃতন্ত্রের খড়গঃ আইন বা বিধিবিধান
- মুসলিম এবং হিন্দু পিতৃতন্ত্র নারীদের ওপর কিভাবে খড়গ নামায় তার কথা বলা হয়েছ।
6.
নারীর শত্রুমিত্রঃ রুশো, রাসকিন,
রবীন্দ্রনাথ এবং জন স্টুয়ার্ট মিল - ফরাসী দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো, ইংরেজ
সমাজপতি জন রাসকিন এবং বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সমালোচনা করা হয়েছে এঁদের
পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতার কারণে এবং ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের পক্ষে কথা বলা হয়েছে তার নারী-অধিকার
বিষয়ক লেখনীর জন্যে।
7.
ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার, ও
মনোবিশ্লেষাণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা - প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড নারীদেরকে কোন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে
দেখতেন তা এই অধ্যায়তে লিখিত হয়েছে।
8.
নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর - নারীদের
শরীর যে পুরুষতন্ত্রবাদী সমাজ নিষিদ্ধ করে রাখে তা বোঝানো হয়েছে।
9.
বালিকা - এই অধ্যায়ে বালিকার বেড়ে
ওঠার বর্ণনা রয়েছে।
10. কিশোরীতরুণাঁ
- কিশোরীদের জীবন কোথায় কেমন তা বলা হয়েছে।
11. নষ্টনীড়
- নারীদের মাসিক ঋতুস্রাব(Menstruation) সম্বন্ধে বলা হয়েছে, পুরুষতন্ত্রবাদী
সমাজ ঋতুস্রাবকে গোপন রাখে - এমনতা বোঝানো হয়েছে।
12. প্রেম
ও কাম - প্রেমকে সাংস্কৃতিক (পুরুষতন্ত্রবাদের সৃষ্টি) এবং যৌনতাকে মানুষের জৈবিক,
আদিম এবং মৌলিক চাহিদা বোঝানো হয়েছে।
13. বিয়ে
ও সংসার - পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় বিয়ে নারীদের জন্য যে একটি পেশা এবং এতে
নারীরা যেয়ে একটি পুরুষের সঙ্গে সংসার করে তাদের জীবন অবিকশিত করে দেয় তা বোঝানো
হয়েছে।
14. ধর্ষণ
- পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কেন ধর্ষিত হয় তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ব্যাখ্যা
রয়েছে এই অধ্যায়ে।
15. মেরি
ওলস্টোনক্র্যাফ্টঃ অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু - প্রখ্যাত ইংরেজ নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্রাফট এর সংক্ষিপ্ত জীবন-কাহিনী এই
অধ্যায়ের মূল বিষয়।
16. রামমোহন
ও বিদ্যাসাগরঃ প্রাণদাতা ও জীবনদাতা - ব্রিটিশ আমলের দু'জন বাঙালি রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করা হয়েছে, রামমোহন সতীদাহ প্রথা বাতিলের পক্ষে
ছিলেন আর ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন বিধবা-বিবাহ প্রচলনের পক্ষে।
17. পুরুষতন্ত্র
ও রোকেয়ার নারীবাদ - প্রাক-বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণকারী প্রথম পুরোদস্তুর
নারী-অধিকারবাদী লেখিকা ছিলেন রোকেয়া, এই অধ্যায়তে তার সম্বন্ধে কিছু তথ্য আছে।
18. বঙ্গীয়
ভদ্রমহিলাঃ উন্নত জাতের নারী উৎপাদন - উনিশ শতকের বাংলার সমাজে নারীরা কিরকম
জীবন-যাপন করতো তার বর্ণনা এই অধ্যায়ের বিষয়।
19. নারীবাদী
সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা - নারীবাদী বিদেশী সাহিত্যের মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন
রয়েছে এই অধ্যায়ে।
20. নারীদের
নারীরাঃ নারীদের উপন্যাসে নারীভাবমূর্তি - নারীকেন্দ্রিক বাংলা উপন্যাসে নারীকে
কিভাবে উপস্থাপন করা হয় বা হয়েছে সেটা এই অধ্যায়ের বিষয়।
21. নারীর
ভবিষ্যৎ - নারীর ভবিষ্যৎ কিরূপ হওয়া উচিৎ বা হবে তার কিছুটা রূপরেখা দেওয়া
হয়েছে এখানে।
এবার
অনলাইন পোর্টাল থেকে লেখক এবং এই বই সম্পর্কে আমার পড়া কিছু কথা বলিঃ
বইটির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হল, এটি নাকি 'দ্যা সেকেন্ড
সেক্স'এর কপি! আহমদ ছফা বলেছেন আর তাতেই নাকি তা সত্য হয়ে গিয়েছে! ছফা যেন কোনো
ত্রুটিহীন ঈশ্বর!! ছফার এমন বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে সে চিরকাল আমার অপছন্দের
তালিকায় থাকবে। তার নির্লজ্জ মিথ্যাচার কি অন্ধভাবেই না একশ্রেণীর মানুষ গ্রহণ করে
আসছে। এরা জীবনেও সেকেন্ড সেক্স ছুঁয়ে দেখেনি, ছফার মতই! ছুঁলে তারা কখনোই এমন
মন্তব্য করতে পারত না!! শুধু একথাই বলি, একবার দুটো গ্রন্থ পড়ে উঠুন, তারপর যদি,
" নারী,সেকেন্ড সেক্সের নকল।" কেউ দাবি করতে পারে তবে তার মানসিক
সুস্থতা প্রশ্নবিদ্ধ!
_______________________
একটা ইন্টারভিউতে হুমায়ুন আজাদ স্যারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো
আপনার “নারী” বইটি কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো? উত্তরে তিনি বললেন, সমস্ত বই থেকে
মাত্র দশটি উদ্বৃতি উল্লেখ করে তারা বইটি নিষিদ্ধ করেছে। ওই দশটি উদ্বৃতি থেকে
মারাত্বক উদ্বৃতি এই বইতে ভরা রয়েছে কিন্তু সেগুলো তো পড়েনি। সামনে যেটি পেয়েছে
সেইটি নিয়ে তারা নিষিব্ধ ঘোষনা করেছে। বইটি অনেক বড়, ওই বই পড়ার এবং বুঝার মত
জ্ঞান কোন সচিব, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর নেই (তখনকার প্রধানমন্ত্রী), তিনি
বললেন।
বইটি যারা পড়েছে তারা
অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন তার কথা কতটা যুক্তিসঙ্গত।
তো,বইটি পড়ে আসলে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম
নিয়েছে।না পারা যাচ্ছে লেখকের পক্ষে যেতে আবার না পারতেছি এগুলোকে উপেক্ষা করে
যেতে।
তো আপনি যদি
বইটি পড়ে থাকেন তাহলে কমেন্ট করে অবশ্যই বইটি নিয়ে আপনার নিজের প্রতিক্রিয়া তুলে
ধরবেন।
আজ এই পর্যন্তই,দেখা হবে নতুন ভিডিওতে।সে পর্যন্ত শুভকামনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thank you for your valuable comment.