সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১

বিন্দুর ছেলে-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ছোট গল্প/উপন্যাস (বই রিভিউ)

 "বিন্দুর ছেলে" অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি ছোটগল্প । গল্পটি ১৯১৩ সালে রচিত। একান্নবর্তী কিংবা যৌথ পরিবারের পারিবারিক সম্প্রীতি, টানাপোড়নসহ নানা চড়াই-উৎরাই সুন্দরভাবে গল্পেটিতে তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পটা যৌথ থেকে একক পরিবারে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কার একটা ক্রাইসিস মুহূর্ত নিয়ে লিখা।

প্রায় দুই দশক আগে ঠিক আমাদের পরিবারটাও এই গল্পের মতো একটা যৌথ পরিবারে হাসি কান্না, মায়া মমতায় টইটম্বুর ছিল। যদিও এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন একক পরিবারের জয়জয়কার অবস্থা।এই গল্পের মূল চরিত্র বিন্দু এবং তার ছেলে অমূল্য।


গল্পটি শুরু হয়  যাদব ও মাধব নামের দুই ভাই এবং যাদবের স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে নিয়ে।যদিও যাদব ও মাধব তারা সহোদর না।তবে তাদের সম্পর্কটি এতটাই গভীর যে এটা সবাই ভুলেই যায়।দরিদ্র যাদব ও তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা অনেক কষ্ট করে মাধবকে পড়াশোনা করিয়ে ওকালতি পাস করায় এবং বিন্দুবাসিনী এর সাথে বিয়ে দেয়।এই বিন্দুবাসিনী চরিত্রকে এখানে সংক্ষেপে বিন্দু বলা হয়েছে।

এই বিন্দু ছিলো রূপবতী, রূপের সাথে ছিল অহংকার ও অভিমান।ফলে তাকে কিছু

বলাও যেত না কারণ তাকে কিছু বললেই তার ছিল মূর্ছা যাওয়ার ব্যামো।কিন্তু অন্নপূর্ণা এই ব্যামো এর প্রতিকার খুঁজে বের করে যা হলো বিন্দুকে অন্নপূর্ণার ছেলে অমূল্য এর দায়িত্ব দেওয়া। ফলে বিন্দুর নিকটই অমূল্য বেড়ে উঠতে থাকে আর তাকেই মা এর আসন এ দেখতে থাকে।

তবে পারিবারিক কিছু প্রেক্ষাপট এই মাতৃস্নেহ কে যেভাবে প্রভাবিত করে তার এক মনোমুগধকর বর্ণনা লেখক এই বইটিতে আবেগভরা হতে ফুটিয়ে তুলেছেন। 

 

এবার কিছু কথা বলতে চাই,

একটা সংসারে সুখ দুঃখ দুইটাই থাকবে, সংসার একক হোক আর যৌথ। তাহলে কেন শুধু শুধু যৌথকে ভেঙ্গে একক করা লাগবে? সময়, শ্রম, অর্থ, সম্পদ সব কিছুরই ক্ষতিসাধন করে এই একক পরিবার প্রথা।

 

তবে, সংসারের সবচেয়ে বেশী অশান্তি যে স্ত্রী লোকদের জন্য হয় সেটাও এই গল্পে স্পষ্টত। দুই জা'এর মধ্যে দ্বন্দ্ব এক পরিবারকে দুই পরিবার, এক ঘরকে দুই ঘর করতে পারে। পারে একই মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া দুই ভাইকে আলাদা করতে, পারে দুই ভাইয়ের আদরের বোনকে হিংসা করতে। নারী আসলেই আজীব, না তাদের ছাড়া আমরা চলতে পারি, না তাদের নিয়ে আমরা চলতে জানি।

তবে, যৌথ পরিবার মানেই হচ্ছে ভিন্ন এক ধরণের ভালোবাসা, মায়া মমতা। একক পরিবারে মা-বাবা তার সন্তানের জন্য উইল করে, যৌথ পরিবারে কাকিমা, জেঠিমাদের উইলেও স্থান পাওয়া যায়। এসব সম্পদের লালসা নয়, ভালোবাসা এবং এর বিশদ পরিধি। অনেক দূরের মানুষকে আমরা ভালবাসতে পারি, দেশের বাহিরের মানুষকেও আমরা ভালবাসতে পারি, কিন্তু নিজের পরিবারকে ভালবাসতে পারি না। আগে নিজের দাদার, নিজের বাবার এবং নিজের পরিবারকে একসাথে রাখার প্রবণতাটা ফিরিয়ে আনা উচিত, তাহলেই একে একে ভাঙা পরিবারগুলো ধীরে ধীরে জোড়া লাগতে শুরু করবে, জেগে উঠবে পুরনো ভালোবাসা, পুরনো মায়া-মমতাগুলো।

যৌথ পরিবার বরাবরই সবার পছন্দ। যৌবন বয়সে একটা ধাক্কা আর হিংসার মিশ্রণে অনেকেই আলাদা হয়ে গেলেও একটা বয়সে মানুষ ঠিকই সেই শৈশবের কাকাতো জেঠাতো ভাইবোনদের সাথে এক সাথে থাকার অভাবটা অনুভব করে এবং তখনি বুঝতে পারে যৌবনে একক পরিবারকে প্রশ্রয় দেওয়ায় বার্ধক্যে এসে নিজে পুরোই একা হয়ে গেছে।

এখন আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর বন্ধু বানাচ্ছি কিন্তু বাস্তবে নিজের আশপাশে তেমন বন্ধু তৈরি করছি না, বুড়ো বয়সে না পারবো চোখের ব্যথায় মোবাইলে তাকাতে, না পারবো কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলে কিছু টাইপ করতে। পরিবার প্রথাটাও তেমন, যখন একটু বেশী স্বাধীনতা, আরেকটু বেশী প্রাইবেসির দোহাই দিয়ে স্ত্রী/স্বামীকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করে, তখন থেকেই জীবনের শেষ পর্যন্ত একা থাকাটাই নিয়ম হয়ে যায়। কেননা, তখন তার সন্তানও তার কাছ থেকে স্বাধীনতা চাইবে, তার কাছ থেকে দূরে গিয়ে প্রাইবেসি খুঁজবে।

একটু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, একটু মিলিয়ে চলার চেষ্টা, একটু ভাব/অহংকার বিসর্জন দেওয়া, একটু পরবর্তী প্রজন্মের কথা এবং পরকালের কথা মাথায় রাখলেই আমরা পরিবার প্রথাটা টিকিয়ে রাখতে পারি, ঠিক কয়েক দশক আগে যেমনটা ছিল।

ভ্রমণ করলে যেমন পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানা যায়, তেমনি বই পড়লেও অনেক আগের যেমন শতাব্দীর আগের পরিবার সম্বন্ধেও জানা যায়।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thank you for your valuable comment.